সরেজমিনে গাংনীর ভোলাডাঙ্গা গ্রাম......... মানুষ পানির আদলে খাচ্ছে বিষ
গাংনীর ভোলাডাঙ্গা থেকে ফিরে এম এ লিংকন - মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুরে এক নিভৃত পল্লীর নাম ভোলাডাঙ্গ...
গাংনীর ভোলাডাঙ্গা থেকে ফিরে এম এ লিংকন- মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুরে এক নিভৃত পল্লীর নাম ভোলাডাঙ্গা। প্রায় ৩ হাজার লোকের বসতি এ গ্রামে। গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মাথাভাঙ্গা নদী। একদিন এই গ্রামবাসীর মনে ছিলো আনন্দ। সন্ধ্যার পর বাউলরা গানে গানে মাতিয়ে তুলতো গ্রামবাসীকে। মাঝিরা গাইতো জারী সারি ভাটিয়ালী গান। গাঁয়ের বধুরা গোসল সেরে কাংখে কলস নিয়ে জল ভরে আনতো। বাজতো রাখালের বাঁশির সুর। আজ আর নেই সেই জৌলুস। আর্সেনিকের করাল গ্রাসের ফলে বিলীন হয়ে গেছে। আর্সেনিকের বিষে এ পর্যনত্ম ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। গ্রামের শতকরা ৮০ ভাগ লোক এ আর্সেনিকে আক্রানত্ম। সরকারী কোন উদ্যোগ না থাকায় ও কয়েকটি এনজিওর সদিচ্ছা থাকা স্বত্বেও অর্থনৈতিক কারণে তেমন কোন কাজ করতে পারছে না। ফলে গ্রামবাসীরা ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর্সেনিকের কারণে কেউ ঐ গ্রামে আত্মীয়তাও করতে চাইছে না বলে জানালেন গ্রামবাসী।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে জানা যায়, এক যুগ আগে থেকেই ভোলাডাঙ্গা গ্রামবাসী আর্সেনিকে আক্রানত্ম। এক বছরের মধ্যে ২০/২৫ জনের প্রাণহানী হওয়ায় এবং গায়ে হাতে ক্ষত দেখা দেওয়ায় কয়েকজন চিকিৎসকের শ্মরণাপন্ন হয়। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর গ্রামবাসী বুঝতে পারেন আর্সেনিক আক্রানত্ম হয়েছে। এ সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আসে ভোলাডাঙ্গার পানি, মাটি পরীক্ষা করতে। কিন্তু কোনই উপকারে আসেনি এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা। কেননা সর্ব প্রথম প্রয়োজন আর্সেনিক মুক্ত পানির ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ ব্যবস্থা সীমিত। গ্রামবাসীরা জানালেন, প্রথম পর্যায়ে গাংনী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ৬টি আর্সেনিক মুক্ত পানির নলকুপের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গাস্থ হীড এনজিও ২টি কুপ নির্মান করে দেয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কুপগুলো নিম্নমানের ও সংস্কারের কোন ব্যবস্থা না করায় সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। পরিচর্যা ও রক্ষনাবেক্ষনের ব্যবস্থা থাকায় হীড এনজিওর ২টি কুপ রয়েছে সচল।
আর্সেনিক আক্রানত্ম মফিজ উদ্দীনের ছেলে বজলু (৪১) সাদেক আলীর ছেলে সাকেম (৩২) ও আসাদুল (২৬) জানান আজ তাদের সামনে শুধুই অন্ধকার। বিভিন্ন সংস্থা তাদের ব্যবহৃত নলকুপ গুলোর শুধু লাল রং দিয়ে গেছে কিন্তু সবুজ রংয়ের কুপের ব্যবস্থা করেনি। কেউ এগিয়ে আসছে না চিকিৎসা দিতে। একই কথা জানালেন অসুস্থ আরজেল আলীর ছেলে সিদ্দিক (৪০)। গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি সকুল শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম জানান, অর্সেনিকের ভয়াবহতা নিরুপন করা হয়েছে কিন্তু প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনেকেই এর করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে স্ব-পরিবারে শহরে চলে গেছে। অনেকেই সম্পদ-জায়গা জমির কারণে গ্রাম ত্যাগ করতে পারছে না। ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে, জেনে শুনেও করছে বিষ পান। পার্শ্ববর্তী কোন গ্রামের লোকজন আত্মীয়তা করতে চাইছে না। প্রচনড মানষিক চাপের মধ্যে রয়েছে সবাই। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো গোটা গ্রামবাসী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি গাংনীস্থ স্থানীয় এনজিও আরভি, ওআরডি,শানঘাট পল্লী উন্নয়ন সংগঠন,এইচ,আর,ডি,পি আশ্রয় সমাজ উন্নয়ন সংস্থাএবং স্বেচ্ছায় আর্সেনিক আক্রানত্ম রোগী সনাক্তকরণ, চিকিৎসা সেবা প্রদান, আর্সেনিক আক্রানত্মদের করণীয় সভা-সেমিনার সহ নানা কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। তবে সংকুচিত অর্থ-সামর্থ্যের কারণে যথাযথ কাজ করতে পারছে না। আর্সেনিক বিষয়ে গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহবুব এবং মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞ প্রশিকা মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের কো-অর্ডিনেটর তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, আর্সেনিক সেচের মাধ্যমে প্রতিটি ফসলের মধ্যে প্রবেশ করে। উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ বিদেশে রপ্তানী হয়। বিশ্ব বাজারে এই উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে আর্সেনিক পাওয়া গেলে বাংলাদেশ চিরতরে বিশ্ববাজার হারাবে।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সুত্র সময়ের কাগজ কে জানান, আর্সেনিক মুক্ত কুপ নির্মান করার পর নানা ত্রুটির কারণে সেগুলো তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। জনবল না থাকায় সার্বক্ষনিক তদারকি করা যায়নি। উপরনত্ম গ্রামবাসীরা কেউ খাবার পানি সংগ্রহের জন্য দুরে যেতে নারাজ। সেহেতু অবজ্ঞা-অবহেলা রয়েছে তাদের মাঝে। ঠিকানা মানব কল্যাণ সংস্থার ম্যানেজর মাজেদুল হক মানিক জানান, আর্সেনিক প্রতিরোধ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কে অবহিত করা হয়েছে কিন্তু জবাব মেলেনি। সম্মিমিলত প্রচেষ্টায় যদি আর্সেনিক নিরসন না হয় তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। অকালে ঝরবে তরা তাজা প্রাণ।